গত পর্বের লিঙ্ক- এক রাত্রির গল্প এবং ( রিয়া পর্ব ১)
অনন্যা এই প্রশ্ন করার পরই হঠাৎ লাইনটা কেটে গেল। ও ভাবল কী হল। কিন্তু ও পাশ থেকে কোন কল এল না।ও ফোন ধরার জন্যে অধীর হয়ে বসে আছে। আশ্চর্য! ঘন্টা খানেক আগেও যে ফোন ধরতে চাইছিল না, কথা বলতে ছিল নিদারুন অনাগ্রহ-সেই এখন কথা বলার তৃষ্ণায় পাগল হয়ে উঠেছে। নিজেকে সামলে নিতে পারল না অনন্যা। দু মিনিট যেতেই নিজেই ফোন করে বসল-
-কী ব্যাপার তন্ময়? ফোনটা রেখে দিলেন কেন? এতক্ষণ তো বারবার বলছিলেন আপনার সাথে কথা বলব এখন কী হল?
সরি রিয়া। আমি আপনার ফোন রেখে দিইনি। চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাই ভাবলাম চার্জ হবার পর ফোন দেই।
আসলে তন্ময়ের চার্জ শেস হয়ে যায় নি । কথার আগ্রহ সপ্তমে তুলে ফোন কেটে দেয়া তার পুরোনো অভ্যাস । যাই হোক খূব দ্রুতই অনন্যা উত্তর করল
-আর ততক্ষণ আমি কি করব। বসে থাকব চাতক পাখি হয়ে?
বাহ্ একটু আগে যার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলেন না,তার ফোন কলের জন্য এমন হাপিত্যেশ,বেশ রহস্যজনক।suspicious!
-আশ্চর্য!আপনিতো আচ্ছা একগুয়ে লোক। ফোন করবেন, কথাও বলবেন আবার সুযোগ পেলে পঁচাতেও ছাড়বেন না। আপনাকে আর সুযোগ দেব না। আমি, আমি এখন......
এখন কী কাঁদবেন?
-অসহ্য জোকার একটা! আচ্ছা আপনি কি করেন বলুনতো? নিশ্চয়ই সারাদিন নাক ডেকে ঘুমান। আর সন্ধ্যা হতেই মাথায় ভর করে বসা শয়তানটা বের করতে শুরু করেন?
নারে ভাই।আপনার মত তো আর আমার বাবার বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট নেই-যার বারান্দায় দাড়ালেই প্রেমিক যুগলকে বোটে ভাসতে দেখা যায়! আমারতো কাজ করতেই হয়! কী আর করব পড়াশোনা করছি। তা আপনি কী করেন, কী পড়ছেন?
-আমি পড়াশোনা করি কী না, আমার বাবার এপার্টমেন্ট কোথায় সবই জানেন দেখছি,রহস্যময় ব্যাপার! আপনাকে কিছু লুকোব না।আমি মেডিকেলে আছি,ডি এম সিতে। আপনি?
এইত মধ্যবিত্তরা সাধারণত যেখানে পড়তে পারলে স্বর্গ হাতে পেয়েছে বলে মনে করে! যেখান থেকে পাশ করে বের হলে অন্তত খেয়ে পরে বাঁচতে পারব। মোটামুটি তেমন একটা প্রতিষ্ঠানেই পড়ছি।
-এত ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলছেন কেন?খেয়ে পড়ে বাঁচার জন্যে তো মানুষ কুলিগিরিও করে। আপনি কী তবে কুলি....
আপনি বোধহয় ভুল পথে হাটছেন! কুলি গিরি করার জন্য পড়াশুনা করতে হয় আমার এই জীবনে প্রথম শুনলাম। অবশ্য আপনাদের মত বেকুবদের কুলিগিরিও লেখাপড়া করে শিখতে হয়। তা রাণী সাহেবা রান্নাটাও শিখে নেবেন, কোন স্কুলে ভর্তি হয়ে! যত বড় বাপের ঝি হোন না কেন-রান্না কিন্তু বাঙালি নারীর অলঙ্কার।
-তোমার সাহস তো কম নয়। আমায় বেকুব বললে।এই যা তুমি করে বলে ফেললাম। কিছু মনে করবেন না। হ্যা যা বলছিলাম.....
তা তেমন কোন কাজের কথা হচ্ছিল না। যা সত্যি তাই আমি বলেছি । তুমি বলার জন্য ধন্যবাদ। আপনি বলতে বড্ড ক্লান্ত লাগছিল।
-বেশ। তা কোথায় পড় তুমি ?
যেখানে পড়ার জন্য সবাই মুখিয়ে থাকে। যেখানে পড়া student রা সবার কাছে সম্পদ বলে স্বীকৃত হয়, ভাল বলে বিবেচিত হয়। নিজেকে জিনিয়াস বলে ভাবতে পারে।
-ও আচ্ছা নিজেকে জিনিয়াস ভাব ?
অবশ্যই,ওটাই তো আমার একমাত্র অহংকার। এখানে আমি কাউকে হাত দিতে দেই না। লোকমুখে নিজেকে জিনিয়াস শুনতে বেশ লাগে ।
-আচ্ছা ভার্সিটির নামটা এত পেচিঁয়ে বলছ কেন?
তোমার তো এতক্ষণে বুঝে যাবার কথা। তুমি না বেকুব নও!
-সে তো প্রথমেই বুঝেছি। বুয়েটে তো?
হুম!
-কোন সাবজেক্ট?
সিভিলে।
-ভাল। তা জিনিয়াস বয়, এই সহজ কথাটা এত ঘুরিয়ে বলার উদ্দেশ্য কী?
কিছুই না, শুধু তোমাকে আমার প্রতি আগ্রহী করে তোলা। তুমি আমার প্রতিটি কথায় বিস্মিত হবে, ভাববে কে আমি- এটাই হবে আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।
-অসভ্য,তুমি আমার দেখা সবচেয়ে বড় অসভ্য।
স্বীকার করছি, আমি অসভ্য। কোন সন্দেহ নেই। বরং আমার সন্দেহ, আমার চেয়ে বড় কোন অসভ্য আছে কি না। তবে মাই ডিয়ার একটা জায়গায় অবজেকশন -তুমি আমাকে কিন্তু দেখোনি কোনদিন।
-তা হতে পারে। আচ্ছা খুব শীঘ্রই তোমাকে দেখে নেব।
বাহ্ বাহ্! একটু আগে অপরিচিতের সাথে কথা বলিনা রেকর্ড ভেঙে গেলে কষ্ট পাব, অনেক হয়েছে- এসব বলা রিয়া এবার নিজেই দেখতে চায় তন্ময়কে ! উদ্দেশ্য কী রিয়ার, প্রেমের প্রস্তাব দেবে না তো?
-অসভ্য, ইতর কোথাকার। এভাবে বললে! যাও ফোন রেখে দিচ্ছি।
আমি জানি, ভুলেও তুমি এখন ফোন রাখবে না এবং লাইন কেটে গেলেও আবার ফোন করবে।
-কি, নিজেকে ভাব কী তুমি? তোমার সব ধারণাই সত্যি হবে-একথা ভাবলে কী করে। শুনি এর পেছনে তোমার যুক্তি?
অতি সহজ এবং অকাট্য যুক্তি। শোন তবে- তুমি আর আমি কথা বলছি কতক্ষণ? পাক্কা দেড় ঘন্টা। তুমি কে ? এমনই একজন-যে কীনা অপরিচিত কোন ছেলের গলা শোনা মাত্র ফোন রেখে দেয়। সেই তুমি যে মন্ত্র মুগ্ধ অবস্থায়,আমার খোঁচা সমৃদ্ধ অমৃত বচন গুলো নিবর সম্মতিতে হজম করছ- এতে কী প্রমাণ হয় না? আরও কিছু শুনবে?
-উফ্!অসহ্য,কথাগুলো বড্ড একঘেয়ে লাগছে।প্লিজ মুক্তি দাও। অন্য প্রসঙ্গে আস।
এত অল্পেই মুক্তি চাইছ?আরও আছে,শুনবে না?একটা প্রশ্ন করব ঠিক ঠিক উত্তর করবে তো?
-করব। প্রশ্নটা বল।
আমি ফোন করবার আগে তুমি কিছু একটা ভাবছিলে এবং তোমার মন বেশ খারাপ ছিল। আমি কী ভুল বললাম?
-আশ্চর্য তুমি কি করে বুঝলে?
এই বলার পর অনন্যা বিষ্ময়ে চুপ মেরে গেল। কিছুটা সময় পর বিষ্ময়ের ঘোর কাটতেই বলল-আচ্ছা তুমি তো মানুষের মন বেশ ভালই পড়তে পার! এক কাজ করলে না কেন? সাইকোলজি পড়তে!
সাইকোলজি পড়ব? হাহ্ এমনিতেই আমরা সবার কাছে সাইকো নামে পরিচিত। তার পরে সাইকোলজি পড়লে.... আল্লাহ্ মালুম! এসব অর্থহীন কথা রাখ। আচ্ছা তুমি কী বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ কর? এটা কিন্তু আমার বেশ লাগে। আর যে বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। কী প্রবল বেগ! বৃষ্টিতে ভেজার জন্যে একদম পারফেক্ট ! কি হল উত্তর করছ না কেন?
-কি বলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। অনেকটা সময় নিরবতার পর বলল অনন্যা।
তখন বিরক্ত হয়েই তন্ময় বলল - আরে, না বোঝার কি আছে? আসলে তুমি কোন কাজের না। ছাদে যাও আর বৃষ্টিতে ভেজ। এরপর আমাকে ফোন দাও। জীবনে একটা এ্যাডভেঞ্চার কর।বিয়ে হয়ে গেলে তো চুলো ঠেলতে হবে । অবশ্য তোমার কথা আলাদা । বড়লোক বাপের একটা মাত্র মেয়ে পাচটা দাসী থাকবে । যাক, যাও ছাদে যাও। জানো আমি কতক্ষণ ধরে ভিজছি।
লাইন কেটে দিল তন্ময়।
ওদিকে বিষ্ময়ে একদম বিমূঢ় অবস্থা অনন্যার! রিমনের পর এই প্রথম কেউ ওকে বৃষ্টিতে ভিজতে বলল- তাও রাতে। গত ছয় মাসে সে বৃষ্টিতে ভেজেনি। অথচ ছোটবেলা থেকেই বৃষ্টিতে ভিজেছে সুযোগ পেলেই। জ্বর বাঁধানোর জন্যে কত যে মায়ের বকুনি খেয়েছে তার কোন শেষ নেই। সেই অনন্যা,রিমনের জন্য গত ছ’মাস বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ থেকে বঞ্চিত। হঠাৎ অনন্যা নিজেকেই প্রশ্ন করল-
“কার জন্যে কষ্ট পাচ্ছি। সে তো আরেকজনের সাথে ডেটিং করে বেড়াচ্ছি। সততা সে বজায় রাখেনি। ওর মত একটা নরকের কীটের জন্যে নিজেকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। আমি অবশ্যই ছাদে যাব। বৃষ্টিতে ভিজব আকণ্ঠ। ধেই ধেই করে নাচব। অবশ্যই যাব,অবশ্যই। সিক্ত হব বরষাধারায় । গাইব প্রাণের গান, বর্ষার গান ।
ও সত্যি সত্যি ছাদে গেল। বৃষ্টির সাথে সাথে প্রবল বাতাস। উত্তরী উড়ে যাবার সম্ভাবনা দেখে বেঁধে নিল কোমরে। অসম্ভব সুন্দর বৃষ্টি নেমেছে আজ । কি যে ভাল লাগছে অনন্যার, সে নিজেই জানেনা । হঠাৎ গলা ছেড়ে সে গেয়ে উঠল আজি বরিষণো মুখরিত শ্রাবণো রাতে - এই গানটা । মিনিট দশেক পর ফোন লাগাল তন্ময়-আজকের আশ্চর্যকে।
-হ্যালো তন্ময়। বলত আমি কোথায়?
আর কোথায়,শাদে (ছাদের বিকৃত)! মহারাণী ছাদে ওঠার জন্য ধন্যবাদ। একটা কাজের মত কাজ এত দিন করতে পারলেন। যাক একটা কথা শিওর হলাম-বাপকা বেটা,সিপাইকা ঘোড়া-তেমনি তন্ময় কা রিয়া।
-তন্ময়,তুমি তো আসলেই অসভ্য।ভেবেছিলাম ছাদে উঠতে বলায় তোমায় ধন্যবাদ জানাব। আর তুমি কিনা! ধ্যাৎ ,মুডটাই নষ্ট করে দিলে।
দেখো,আমি শুধু এই একটা কাজই পারি। সবার বাড়া ভাতে ছাই দিতে!
-এবার আর না হেসে পারল না অনন্যা। জোরে বলে উঠল -তুমি পারও বাবা! যাই হোক তন্ময়। তোমাকে একটা সত্যি কথা বলি-গত ছয়টি মাসে আমার এত বিনিদ্র রজনী পার হয়েছে যে গুনে বলতে পারি কটা রাত স্লিপিং পিলস ছাড়া ঘুমোতে পেরেছি। আজ রাতে আমার বেশ ভাল ঘুম হবে।
চলবে, গল্প দুই পর্বে শেষ না হওয়ায় দু:খিত । তবে অস্থিরমতি বালিকা আর চপলমতি বালকদের এই ধারা ভালই লাগে খবর পেয়েছি । সবাই ভাল থাকবেন ।
পরবর্তী পর্ব : এক রাত্রির গল্প এবং রিয়া